ঈদের ছুটিতে জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছে বাগেরহাটের শরণখোলার ‘রায়েন্দা বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকোপার্ক। প্রমত্তার বলেশ্বর নদের বিশাল জলরাশি আর নীল আকাশের মিতালী আকৃষ্ট করছে বিনোদন প্রেমিদের। ঈদের ছুটিতে প্রকৃতির সেই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসে দর্শনার্থীরা। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অন্যতম আকর্ষনীয় স্থানে পরিনত হয়েছে সুন্দরবন উপকূলে গড়ে ওঠা এই বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকেপার্ক।
ঈদের প্রথম দিন (২২এপ্রিল) ও ঈদের দ্বিতীয় দিন (২৩ এপ্রিল) সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিল ধারণের জায়গা ছিলনা বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকোপার্কে। দুই দিনে লক্ষাধিক দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এখানে। শিশু থেকে বুড়ো সাবাই ছুটে আসে বলেশ্বর পারে। সোমবার (২৪ এপ্রিল) ঈদের তৃতীয় দিনেও বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত হাজার হাজার দর্শনার্থীর দেখা যায় বলেশ্বর পারে। নিয়মিত দর্শনার্থীর বাইরেও ঈদ উপলক্ষ্যে আরো তিন থেকে চার দিন ইকোপার্কে বাড়তি লোকসমাগম ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকোপার্ককে কেন্দ্র করে পাশেই গড়ে উঠেছে উন্নতমানের একটি রেঁস্তরা। ইকো-প্যাডাইস নামের এই ক্যাফে রেঁস্তরাটি দর্শনার্থীদের এনে দিয়েছে এক ভিন্নমাত্রা। দেশিয় খাবারের পাশাপাশি চাইনিজ ও জাপানিজ বিভিন্ন খাবারের আইটেম রয়েছে এই রেঁস্তরায়। ঈদের আগের রাতে উদ্বোধন করা হয় এই রেঁস্তরাটি। সেই থেকে দিনরাত সমানতালে চলচে খাবার পরিবেশন। ক্রেতার চাপে দম ফেলারও সময় পাচ্ছে না রেঁস্তরা পরিচালনায় নিয়োজিতরা।
পার্ক গঠনের ইতিকথাঃ ২০২২ সালের মাঝামাঝি দিকের কথা। ঝড়-জলোচ্ছাস থেকে বাঁচতে পানি উন্নয়ন বোর্ডে ৩৫/১ পোল্ডারের অধীন বলেশ্বর নদের তীররক্ষায় বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নির্মাণ হয় টেকসই বেড়িবাঁধ। ওই বাঁধের পাশে বসানো হয় কংক্রিটের ব্লক। উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজার থেকে কিছু দূরে বড়ইতলা নামক স্থানের সেই ব্লককবাঁধের এক কিলোমিটার এলাকায় একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় শরণখোলা উপজেলা প্রশাসন। এটির নামকরণ করা হয় ‘রায়েন্দা বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকোপার্ক’ নামে। প্রথমে ব্লকে বিভিন্ন রঙে রঙিন করে বৈচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। এর পর একে একে বসানো হয় বিচ খাট, রঙিন ছাতা, দোলনা, বেঞ্চি, লাভ পয়েন্ট ও রঙধনু টানেল। সামাকিজ যোগাযোগ মাধ্যমে পার্কের বৈচিত্রময় ভিডিও এবং ছবি ছড়িয়ে পড়ায় আকৃষ্ট করে বিনোদন প্রেমিদের।
বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকোপার্কের বৈশিষ্ট্যঃ পার্ক এলাকায় অবস্থানকালে বাড়তি কোনো ফি দিতে হয় না দর্শনার্থীদের। সামাজিক পরিবাশে বজায় রেখে এখানে তাদের ইচ্ছেমতো ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। তবে রঙিন ছাড়ার নিচে বিচ খাটে বসে বলেশ্বর নদের জলরাশি আর নীল আকাশ উভোগ করতে চাইলে আধা ঘন্টায় দিতে হবে মাত্র ২০ টাকা। আর বলেশ্বর নদের নোনা জলের ছোয়া পেতে চাইলে স্পীড বোটে ঘুরে আসতে পারনে যে কেউ। নির্দিষ্ট সময়ে জনপ্রতি ১০০টাকা ভাড়া দিয়ে ভ্রমণ করা যাবে। দোলনা ও বেঞ্চিতে বসলে কোনো টাকা লাগে না। ছবি তোলার জন্য জন্য রয়েছে লাভ পয়েন্ট ও রিঙের তৈরী রংধনু টানেল। রয়েছে ফুসকা, চটপটিসহ রকমারি খাবারেরও ব্যবস্থা।
পার্কের প্রভাবঃ বলেশ্বর পারে পার্ক স্থাপনের পর থেকে এলাকার আর্থ-সামাকিজ উন্নয়নে কিছুটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। পার্ক ঘিরে এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বাদাম বিক্রেতা থেকে শুরু করে ভ্যান-রিকশা চালকদেরও আগের তুলনায় আয় বেড়েছে। সামাজিক আচার-আচরণেও পরিবর্তনন এসেছে এসব হতদরিদ্র মানুষের। বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকোপার্ক গঠেনের পর ভিন্ন কিছু করার আগ্রহ নিয়ে ইতোমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারাও।
পার্কে চটপটি বিক্রতা আ. রাজ্জাক বলেন, আগে সারা বাজার ঘুরে কোনোদিন পাঁচ শ কোনোদিন এক হাজার বিক্রি করতাম। এখন পার্কে নিয়মিত আসি। প্রতিদিনি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। ঈদের এই সময় প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। পার্কের পাশের ক্ষুদ্র দোকানি জাকিয়া বেগম বলেন, পার্ক শুরু হওয়ার আগে থেকেই বাঁধের পাশে ছোট্ট দোকান তুলে ব্যবসা করছি। পার্ক হওয়ার পর বেচাকেনা বেড়েছে।
ঢাকা থেকে ঈদের ছুটিতে স্বপরিবারে রিভার ভিউ পার্কে আসেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তাহেরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বলেশ্বর পারের সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ। শহুরে ইট-পাথরের জীবন থেকে বেরিয়ে বহুদিন পর প্রকৃতির সান্নিধ্য পেলাম। পাশের ইকো-প্যারাডাইস রেঁস্তরাটির খাবারের মানও খুব ভালো। আমার সন্তানরা এখানে শহুরে মানের খাবার পেয়ে খুব খুশি। এতো সুন্দর একটি উদ্যোগ গ্রহনের জন্য শরণখোলা উপজেলা প্রশমাসনকে ধন্যবাদ জানাই।
ইকো-প্যারাডাইস ক্যাফে এন্ড রেঁস্তরার সিইও মো. সিরাজুল আজাদ বলেন, উপজেলা প্রশাসন ইকোপার্কটি করার পরই আমরা নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখি। পার্কের পাশেই দুই বিঘা জমি কিনে সেখানে রেঁস্তরাটি তৈরী করি। ঈদ উপলক্ষে তড়িঘড়ি করে রেঁস্তরাটি চালু করেছি। এখনো ৫০ ভাগ কাজ বাকি রয়েছে। এখানে চাইনিজ, জাপানিজসহ দেশি-বিদেশি রকমারি খাবারের ব্যবস্থা আছে। দুই দিনে ক্রেতার চাপ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। যা ধারণা ছিল তার চেয়েও দ্বিগুন বিক্রি হয়েছে। পার্কে আসার রাস্তাটি যদি পাকা করা হয় তাহলে সারাবছরই পর্যটকের ভিড় থাকবে এখানে।
রায়েন্দা বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকোপার্কের উদ্যোক্তা ও শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নুর-ই আলম সিদ্দিকী বলেন, সুন্দরবন ঘেঁষা শরণখোলা উপজেলায় বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। সেই চিন্তা থেকে বলেশ্বর পারের বেড়িবাঁধকে আমার বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কাজ চলমান রয়েছে। শুরু থেকেই প্রতিদিনি হাজার হাজার দর্শনার্থী আসছে এখানে। বিশেষ দিনগুলোতে মানুষের ঢল নামে। এবারের ঈদের দুই দিনে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছে এখানে।
ইউএনও নুর-ই আলম সিদ্দিকী আরো বলেন, ইকোপার্কটি করার পর পাশেই একটি উন্নতমানের রেঁস্তরা হয়েছে। ভোজন রসিক দর্শনার্থীরা এসে এখানে ভালোকিছু পাবেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় উদ্যোক্তারও যোগাযোগ করছেন আরো নতুন কিছু করার জন্য।
ইউএনও বলেন, নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের আবেদন করা হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পার্কের আকর্ষন বৃদ্ধিতে কাজ চলমান রয়েছে।