শেষ হয়েছে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুম। এবছর লোকসানে পড়েছেন ৮০ ভাগ মহাজন। কোটি কোটি টাকা লোকসান মাথায় নিয়েই চর ছেড়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছেন জেলে-মহাজনরা। গত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া। পাঁচ মাস পর ৩১ মার্চ আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে বিশাল এই কর্মজজ্ঞের।
গত বছরের তুলনায় মাছ কম পড়া এবং রাজস্ব দ্বিগুণ হওয়ায় এবার চরম লোকসানে পড়তে হয়েছে মহাজনদের। তবে, মহাজনদের লোকসান হলেও এবার সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে গতবারের তুলনায় দেড়গুণ বেশি।
রাজস্ব আয় বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, গত বছর প্রক্রিয়াজাতকৃত এক কেজি শুঁটকির সরকারকে রাজস্ব দিতে হয়েছে ৫টাকা। এবার তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১০টাকা। ফলে, মহাজনদের লোকসান হলেও বেড়েছে রাজস্ব আয়।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর কোলঘেঁষা সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলা জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ির আওতাধীন আলোরকোল, অফিস কিল্লা, নাড়িকেলবাড়িয়া, মেহেরআলী ও শ্যালাসহ পাঁচটি চরে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই পাঁচটি চরে এবছর সর্বমোট শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এ থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা।
অপরদিকে, গত বছর ওই পাঁচটি চর থেকে শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল ছয় হাজার মেট্রিক টন। রাজস্ব আয় হয়েছিল চার কোটি ১৫ লাখ টাকা। সেখানে এবার ৫০০ মেট্রিক টন কম উৎপাদন হলেও রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের আয় বেড়ে যায়।
শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারের বাসিন্দা শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. ইউনুচ ফকির জানান, তিনি প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে দুবলার অফিস কিল্লার চরে শুঁটকির ব্যবসা করছেন। এতো বছরের মধ্যে এবারই তার সবচেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে। গতবারও প্রায় ৪ লাখ টাকা লাখ করেছেন। কিন্তু এবার লোকসান হয়েছে প্রায় ৬৬লাখ টাকা। মাছ কম হওয়া এবং রাজস্ব বাড়ানোর কারণে এই লোকসান গুণতে হয়েছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জাহিদ হোসেন বহাদ্দার (মহাজন) ২৩ বছর ধরে সুন্দরবনের দুবলায় শুঁটকি ব্যবসা করে আসছেন। তিনিসহ পাঁচ ব্যবসায়ী তাদের সবকিছু গুছিয়ে চট্টগ্রামে রওনা হয়েছেন।
শুক্রবার (৩১মার্চ) মুঠোফোনে জাহিদ বহদ্দার জানান, গত বছরের তুলনায় এবছর শুঁটকি ও ঘরের রাজস্ব প্রায় দ্বিগুণ করেছে বনবিভাগ। তাছাড়া এবছর সাগরে মাছ কম ধরা পড়েছে। তাই এবছর তাদের পাঁচ ব্যবসায়ীর প্রায় দেড় কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
একইভাবে লোকসান উল্লেখ করে সুকুমার বহাদ্দার, আবু বহাদ্দার, শফি আলম ও ইসাহাক বহাদ্দার জানান, গত বছর লইট্টা, ছুরি ও লাখ্যা মাছ বেশি পড়ায় শুঁটকির দাম বেশি পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার সাগরে জেলেদের জালে কম দামের বৈরাগী ও অন্যান্য কম মূল্যের ছোট মাছ বেশি ধরা পড়েছে। অথচ রাজস্ব ঠিকই দিতে হয়েছে তাদের। যে কারণে লোকসানে পড়েছেন ব্যবাসয়ীরা।
দুবলা জেলে পল্লীর মৎস্যজীবি সংগঠন ফিশারমেন গ্রæপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এবছর বনবিভাগ রাজস্ব দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। কেজিপ্রতি ৫টাকার রাজস্ব বাড়িয়ে ১০টাকা করা হয়েছে। তাছাড়া, এবার দাবি যেসব মাছ যেমন লইট্যা, ছুরি, লাক্ষা, রূপচাঁদা খুবই কম ধরা পড়েছে। যার ফলে চরের ৮০ ভাগ শুঁটকি ব্যবসায়ী ও মহাজন লোকসানে রয়েছেন। লোকসান মাথায় নিয়েই জেলে ও মহাজনরা চর ছাড়তে শুরু করেছেন।
পূর্ব বন বিভাগের দুবলা জেলেপল্লীর টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল থাকায় মৌসুমের মাঝামাঝি দিকে কয়েক গোন মাছ ধরতে পারেনি জেলেরা। যার ফলে গতবারে তুলনায় এবছর ৫০০ মেট্রিক টন শুঁটকি কম উৎপাদন হয়েছে। তবে রাজস্ব দ্বিগুণ বাড়ায় এবার ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বেশি আয় হয়েছে।
তিনি আরো জানান, শুঁটকি মৌসুম ৩১মার্চ আনুষ্ঠাকিভাবে সমাপ্ত হলেও সব কিছু গুছিয়ে জেলেদের চর ছাড়তে আরো ৪-৫দিন সময় লাগবে। এবছর জেলে-মহাজন ও অন্যান্য মৌসুমী ব্যবসায়ী মিলিয়ে ১০ সহস্রাধিক মানুষ শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ ঘিরে এই পাঁচটি চরে ১ নভেম্বর থেকে পাঁচ মাস অবস্থান করে। এর মধ্য থেকে ইতোমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি তাদের নিজ নিজ এলাকায় চলে গেছেন।