তেইশ বছর বয়সী স্বপ্নবাজ তরুণ সামী হক। অনেকের কাছে পরিচিত ফ্রিল্যান্সার সামী হিসেবে। ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট নিয়ে অনলাইন জগতে ২০১৯ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন এই সফল তরুণ ফ্রিল্যান্স উদ্যোক্তা। পাশাপাশি এখন পর্যন্ত প্রায় তিনশোর বেশি শিক্ষার্থীকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। যাদের মধ্যে অনেকেই তার মাধ্যমে ফ্রিলান্সিং সেক্টরে নিজের ক্যারিয়ার গড়েছেন। সামীর সাথে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করা একজন দুবাই এর একটি আইটি কোম্পানিতে কাজ করতে দুবাইতে পাড়ি জমিয়েছেন।
ক্যারিয়ারের শুরুতে কঠোর পরিশ্রম এবং নিদ্রাহীন অনেক রাত পার করতে হয়েছে সামীর। সেই কঠোর পরিশ্রমই তাকে মাত্র ২৩ বছর বয়সেই ৪০০০০ মার্কিন ডলার( প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা) আয় করাতে সক্ষম করেছে। পাশাপাশি খুব অল্প সময়ই পেয়েছেন সোনার হরিণ খ্যাত ফাইবার টপ রেটেড সেলার ব্যাজ। তাছাড়া নিজের এবং পরিবারের ব্যবহারের জন্যও কিনেছেন গাড়িও।
সামীর ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতা নিয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে। ক্যারিয়ার জার্নি নিয়ে সামী জানান, সাল তখন ২০১৮। আমি সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি। চারদিকে তখন স্টুডেন্ট ভিসায় ইউরোপ যাওয়ার হিড়িক চলছিলো। নিজের হাতে পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশে থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু করার সিদ্ধান্ত নেই। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই টেকনোলজি ও কম্পিউটারের উপর তীব্র নেশা কাজ করতো। সেই নেশাকে প্রফেশন হিসেবে কাজে লাগাতে শাবিপ্রবি থেকে ওয়েব ডেভেলপমেন্টে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সুযোগ হয়। প্রফেশনাল এই কোর্সটি আমাকে স্বপ্ন পূরনে অনেক সাহায্য করেছে।
সামীর শুরুর জার্নিটা মসৃণ ছিল না মোটেই। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে তিনি৷ সামী জানান, শুরুর দিকে ক্লায়েন্ট পেতে অনেক কষ্ট করতে হতো। রাত জেগে তাদের শুধু একটা টেক্সট এর অপেক্ষায় থাকতাম। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমি ঘুমিয়ে থাকলেও কাজের পর কাজ আসতে থাকে। এখন পর্যন্ত সফলভাবে পুরো বিশ্বের প্রায় ৩৫ শতাংশ দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি এখন ফ্রিল্যান্সিং থেকে আউটসোর্সিংয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। আমি কাজগুলোকে অনেকজনের মধ্যে বন্টন করে দেই। এতে করে আমার সাথে থেকে বেকার তরুণরা কাজ করছে এবং ভালো মানের টাকা উপার্জন করছে। আমার সবচেয়ে বেশি খুশি লাগে যখন আমারই কোন স্টুডেন্ট আমার কাজে সাহায্যে করে আমার কাজগুলো করে দেয়। আমি সবসময় বলি যে ওয়েব ডিজাইন এমন একটি সেক্টর যেটা শিখলে শুধু মার্কেটপ্লেসেই নয় বরং আপনার দক্ষতার ভিত্তিতে দেশ-বিদেশের অনেক বড় বড় আইটি কোম্পানি আপনাকে জব অফার করবে। তবে তার জন্য আপনার টেকনোলজির উপর পর্যাপ্ত পরিমাণ দক্ষতা থাকতে হবে।
SH Tech Solution নামে সামীর একটি অনলাইন ভিত্তিক আইটি কোম্পানি রয়েছে যেটার মাধ্যমেও কাজ আসে। তিনি জানান, এই ওয়েবসাইটকে এসইও করে দাড় করাতে দুজন দক্ষ কর্মী মাসের পর মাস কাজ করেছেন। সবমিলিয়ে এটার পিছনে আমার লক্ষাধিক টাকা ইনভেস্ট করতে হয়েছে। একদিন এই অনলাইন ভিত্তিক কোম্পানিকে অফলাইন ভিত্তিক করে বড় অফিস করার স্বপ্ন রয়েছে। যেখানে কাজ করতে পারবেন শত শত মানুষ। অনলাইনে ব্যাচ আকারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি আমি বাংলাদেশের অন্যতম ই-লার্নিং প্লাটফর্ম Instructoy তে Instructor হিসেবে কাজ করছি। তাছাড়া Nii Technology নামের আইটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আছি। samihaque.org নামের ওয়েবসাইট থেকেও শিক্ষার্থীরা আমার কোর্স কিনে শেখার সুযোগ পান। অনেক শিক্ষার্থীরা কাজ পেয়ে নিজেদের কাজ পাওয়ার গল্প সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন। যা অন্যদেরকে কাজ শিখতে আগ্রহী করে তুলে।
ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরের কিছু নেতিবাচক দিক নিয়ে নতুনদেকে সতর্ক করেন সামী। তিনি জানান, বর্তমানে স্বল্প সময়ে ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর নাম করে অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়েছে, যারা মানুষকে লাখ লাখ টাকা উপার্জনের লোভ দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ যারা শিখাবে তাদের বেশিরভাগেরই ফ্রিলান্সিং এ ক্যারিয়ার গড়ার কোন রেকর্ড নেই। এসব ধোকা হতে মানুষকে সচেতন হতে হবে। মনে রাখবেন ফ্রিল্যান্সিং সহজ কিছু নয় যা রাতারাতি শিখে আপনি লাখপতি হয়ে যাবেন। আপনাকে রাতের পর রাত কাজ শিখে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই কেবল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরন করতে করতে হবে।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সামী বলেন, জীবনে সফল হওয়ার জন্য শুরুর দিকে অনেক বাধা বিপত্তি পার হতে হয়। শুরুর সময়টা আমার জন্যও অনেক কষ্টসাধ্য ছিলো। অনেক রাতের পর রাত গিয়েছে আমি ঘুমের দেখা পাইনি। অনেক সময় সাপোর্টার হিসেবেও কাছে পাইনি কাউকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের কুৎসিত কথাবার্তা শুনতে হয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহর উপর আস্থা আর কঠোর পরিশ্রমই আমাকে আমার আজকের পজিশন এনে দিয়েছে। কুৎসিত মন্তব্য করা মানুষরাও আজকে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীতে রুপান্তর হয়েছে। আমার থেকে তারা আজ শিখতে চায়। একসময় যা সত্যিই অকল্পনীয় ছিলো।
দেশের বেকারত্বের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের বেকার সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চাই। শিক্ষিত বেকার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। চাকরির পিছনে না ছুটে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মনোভাব থাকলে বেকারত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
ফ্রিল্যান্সারদের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে পেপাল সুবিধা চালু করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ফ্রিলান্সারদের জন্য নতুন নতুন অনেক সুযোগ সুবিধা এনেছে। যা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু ফ্রিল্যান্সাররা এখনো পেপাল চালু না হওয়ার আফসোসে দিন কাটাচ্ছেন। পেপাল বাংলাদেশে বৈধ না হওয়ার কারনে আমাদের অনেক ভাল ভালো ক্লায়েন্ট হারাতে হয়। পেপাল বাংলাদেশে চালু হলে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিতেও এর সুপ্রভাব পড়বে। তাই বাংলাদেশ সরকারকে পেপাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করার জন্য অনুরোধ করছি।